১৯৪২ সালে গান্ধীর কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের লাইন থেকে তো নেতাজী এবং সাভারকার, দুইজনেই বিপরীতমুখী লাইন ধরেছিলেন। তবুও শুধু ভারতীয় কমিউনিস্টদের নিন্দা করে গেছেন কেন তৎকালীন বিপ্লবী থেকে কমরেড স্ট্যালিন, সবাই?
এই প্রশ্নটা অনেকদিনেরই। এবং উত্তরটা বোধহয় কিছুজনের অজানা। সেই নিয়ে আলোচনার জন্যেই এই পোস্ট। কিন্তু তার আগে...
তার আগে বলেই দিই, এই পোস্ট সবাই না পড়লেও চলবে। লম্বা পোস্ট পড়তে না চাইলে পড়ার দরকার নেই। এটা মোটামুটি আমার ছাত্রছাত্রীদের জন্যেই লেখা, ওদের অনুরোধেই ফেসবুকে দেওয়া।
যাইহোক। ১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্ব রাজনীতি দুটো ভাগে বিভক্ত। অক্ষ শক্তি। মিত্র শক্তি।
এই সময় ভারতীয় রাজনীতি মোটামুটি চারটি ভাগে বিভক্ত। মোটামুটি বলছি এই কারণে, যে এর বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট রয়েছে। যা পরবর্তী সময়ে প্রচুর প্রভাব ফেলবে ভারতীয় রাজনীতিতে। প্রাথমিকভাবে আমরা আলোচনা করবো, তিন রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে। কনটেক্সট বুঝতে জরুরি এটা...
গান্ধী।
১৯৪২ সালের ৮ই আগষ্ট ডাক দিলেন ‘ব্রিটিশ, ভারত ছাড়ো’। এখন এই সময়ে গান্ধীজির রাজনীতিতে সামান্য পরিবর্তন কিন্তু লক্ষ্য করার মতো। কোনো আপোষ আলোচনা নয়। আংশিকভাবে নয়। ইমিডিয়েট এবং আনকন্ডিশনাল। ব্রিটিশ সরকারকে ভারত ছাড়তেই হবে। যতক্ষণ না ব্রিটিশ সরকার ভারত ছাড়ছে, চলবে সত্যাগ্রহ। বয়কট। গণ আইন অমান্য আন্দোলন। করেঙ্গে ইয়া  মরেঙ্গে। বোধহয় এই প্রথমবার ব্রিটিশ সরকার রীতিমতো সমস্যায় পড়েছিল গান্ধীর জন্য [1]। এবং বোধহয় এই প্রথমবার ব্রিটিশ তাড়ানোর ব্যাপারে গান্ধীর এমন জেদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও, অনেকের মতে এই পরিবর্তন অনেকটা তাঁর এক ‘অবাধ্য প্রিয়জন’ সংসর্গের ফল। সে অন্য কোনো সময়ে আলোচনা করা যাবেখন।
যাইহোক, একটু আগে আমি একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলাম। গান্ধীর পরিবর্তন নিয়ে। ‘সামান্য’। এই শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এত জেদ এবং এত কিছুর পরেও গান্ধীর আন্দোলনের একটি ব্যাপার কিন্তু একেবারেই চেঞ্জ হয়নি। বরং তিনি আরও আঁকড়ে ধরেছেন ‘অহিংসা’কে। তাঁর আন্দোলনকে অহিংস হতেই হবে। তিনি বা তাঁর সহকর্মীরা গ্রেপ্তার হলেও এই আন্দোলনকে অহিংস থাকতেই হবে।
সুভাষ বাবু
এই আন্দোলনের একেবারে অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি। অহিংস আন্দোলন দিয়ে যে কোনো বিপ্লব সংগঠিত হতে পারে, তিনি বিশ্বাস করেন না।
তিনি তখন কংগ্রেস ছেড়েছেন। ভারতও। ভারতীয় প্রিজনার্স অব ওয়ারদের নিয়ে INA চালাচ্ছেন। হাত মিলিয়েছেন তেজো এবং অস্ট্রিয়ান পেইন্টারের (নাম নিলে পোস্টটাই উড়বে) সঙ্গে। মোট কথা, ‘এন্ড জাস্টিফাইস দ্য মিনস’ লাইনে বিশ্বাসী তিনি। তাঁর উদ্দেশ্য ইম্ফল কোহিমা লাইনে ব্রিটিশ ভারতকে আক্রমণ করা [2]।
কিন্তু অল্টারনেট রিয়ালিটি ভাবুন একবার। ব্রিটিশ গেল। কিন্তু গোদ এবং বিষফোড়া হিসেবে জাপান এবং জার্মান এলো। জাপানের ওয়ার ক্রাইম জানতে হলে চীনের নানজিং ম্যাসাকার [3], কোরিয়ায় ‘কমফোর্ট ওম্যান’ সিস্টেম [4] এবং বোসবাবুর ‘ক্যাপচার’ করা আন্দামান নিকোবর প্রদেশের হোমফ্রেগঞ্জ প্রদেশে কী হয়েছিল [5], পড়তে পারেন।
যাইহোক, এত লেখার একমাত্র কারণ, কেউই ভবিষ্যত দেখতে পান না। স্বয়ং ভগবানও বোধহয় না...
সাভারকর
সাভারকর কোনোদিনই গান্ধী ভক্ত তেমন ছিলেন না। স্বাভাবিক ভাবেই গান্ধীর ডাকা কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের সঙ্গী হবেন না, জানা কথা। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অন্য। তিনি এই সময়টাকে একটা সুযোগ হিসেবে দেখলেন। ভারতীয় হিন্দু যুবকদের এই সময়ে অফিসের নানা পদ ক্যাপচার করতে উদ্বুদ্ধ করলেন তিনি। আর্মির দ্বারা ট্রেইন্ড হয়ে আসতে বললেন হিন্দু যুবকদের। তিনি ব্রিটিশ খেদিয়ে আবার জাপানীর দ্বারা পরাধীন হতেও চাননি [6]।
যাইহোক, ব্যাপারটা হলো, তিনজনেই কিন্তু নিজেদের জায়গায় সফল হলেন। আসলেই তাঁদের পথ ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ ছিল তো।
গান্ধীর আন্দোলন ব্রিটিশদের বুঝিয়ে দিল, ভারতীয় সহযোগিতা ছাড়া ভারত শাসন অসম্ভব।
সুভাষ বাবুর ইম্ফল কোহিমা লাইন ফেইল হলেও, INA ট্রায়াল পাবলিক অপিনিয়ন বদলে দিল। ব্রিটিশ আর্মির ভারতীয়দের মধ্যে লয়ালিটি বদলে যেতে লাগলো [7]।
সাভারকরের জন্য স্বাধীন ভারতে এত বড় ‘ওয়ার টেস্টেড’ আর্মি পেলাম আমরা [6][7]। যেসব রত্ন প্রতিবেশী পরিবেষ্টিত আমাদের দেশ, এই আর্মি না পেলে কী হতো, খোদায় মালুম!
যাইহোক, তাহলে? কমিউনিস্টদের দোষ কী?
১৯৪১ সালের জুন মাস পর্যন্ত কিন্তু কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ ওয়ার এফোর্ট খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি। বলেছে এসব আসলে ‘সাম্রাজ্যবাদী’দের (Imperialist War) যুদ্ধ। কিন্তু যেই না USSR যোগ দিল মিত্র শক্তিতে, তখনই হঠাৎ সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ বদলে গেল জনযুদ্ধ ( People's War) তে! এমন ইউ টার্ন খুবই কম দেখা যায় [8]।
তারা তখন প্রবলভাবে কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের বিরোধিতা করতে লাগলো। কারণ সেটা তখন নাকি এন্টি ফ্যাসিস্ট শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে!
তারা প্রবলভাবে নেতাজীর বিরুদ্ধতা, কুৎসা করতে লাগলো। কারণ, তিনি তখন সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল! তেজোর কুকুর! (People's War পত্রিকায়) [9]
যখন সাভারকর গান্ধীবাদী না হয়েও, কুইট ইন্ডিয়ার সমর্থক না হয়েও গোপনে সাহায্য করে চলেছেন (বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ বাবুর লেখা ‘জেলে ত্রিশ বছর...’ দ্রষ্টব্য) [10] সেখানে ভারতীয় কমিউনিস্টদের এহেন আচরণ বিস্মিত করেছিল স্বয়ং স্ট্যালিনকেও। তিনি পরবর্তী সময়ে ভর্ৎসনা করেছিলেন কমিউনিস্ট নেতাদের, “তোমরা এটা (কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট) সমর্থন করোনি কেন? তোমরা কি ভেবেছিলে তোমাদের পাঠানো একশো রাইফেল দিয়েই আমরা যুদ্ধজয় করেছিলাম?” [11]
গান্ধী সুভাষ সাভারকর, প্রত্যেকের পথ আলাদা। কিন্তু তাঁদের প্রতিটি পথই “ইন্ডিয়া ফার্স্ট”। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিটি পথই যেন “সোভিয়েত ইউনিয়ন ফার্স্ট”।
এই দায়ভার তো তাঁদের বহন করে চলতেই হবে...
তথ্যসূত্র:
[1] Bipan Chandra, India’s Struggle for Independence (Penguin, 1988).
[2] Leonard A. Gordon, Brothers Against the Raj: Sarat and Subhas Chandra Bose (Columbia Univ. Press, 1990).
[3] Iris Chang, The Rape of Nanking (Basic Books, 1997).
[4] Yoshiaki Yoshimi, Comfort Women: Sexual Slavery in the Japanese Military During World War II (Columbia Univ. Press, 2000).
[5] Bidyut Chakrabarty, Subhas Chandra Bose and the Indian National Army (Oxford, 2011).
[6] Vikram Sampath, Savarkar: A Contested Legacy, 1924–1966 (Penguin, 2021).
[7] Sumit Sarkar, Modern India: 1885–1947 (Macmillan, 1983).
[8] Sobhanlal Datta Gupta, Comintern and the Destiny of Communism in India, 1919–1943 (Routledge, 2006).
[9] People’s War newspaper, Communist Party of India, 1942.
[10] Trilokyanath Chakraborty, Jele Trish Bachar (Memoir, 1966).
Comments
Post a Comment