১. দৌড়তে দৌড়তে বারবার পেছনে তাকাচ্ছিল সে। মেঘলা রাত্তির। এই জায়গায় এখনও পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় সরকারি আলো লাগানো হয়নি। এইসব গ্রামে রাস্তার আলোর জন্যেও যে টাকা বরাদ্দ হয়, সেটা অধিকাংশ গ্রামবাসী জানেই না। তবে ও জানতো। এই নিয়ে পার্টির দাদার সঙ্গে কথাও বলেছে সদ্যই। এই মুহূর্তে এইসব যদিও ওর মাথায় আসছে না। যে ভয়ঙ্কর দৃশ্যের সাক্ষী সে, তারপর আর অন্য কিছু ভাবার বিলাসিতা তার নেই। সামনেই পুলিশ স্টেশন। যেভাবেই হোক ওখানে পৌঁছতে হবে। শরীরের আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ দুর্বল করে দিচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, দৌড়ানোর গতি মন্থর থেকে মন্থরতর হচ্ছে। আর বোধহয় পারলো না...
২. চায়ে চুমুক দিয়েই মুখটা বিকৃত করে ফেললেন থানার বড়বাবু অনিন্দ্য চক্রবর্তী। পাশে দাঁড়িয়ে কনস্টেবল অমিয় ঘোষ একবার তাকিয়ে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। এই দৃশ্যে অভ্যস্ত সে। সামনের চরন বাগের দোকান ছাড়া অন্য কোনো দোকানের চা খাবেন না বড়বাবু। কিন্তু ওই দোকানের চা খুব দায় না পড়লে যে কোনো ভদ্র মানুষ খেতে পারে, সেটা সে জানে না।
বড়বাবু হাঁক পাড়লেন, “ছেলেটা উঠেছে অমিয়?
৩. বড়বাবু দেখেই বুঝতে পারছিলেন ছেলেটার এইরকম চা খাওয়ার অভ্যেস নেই। ছেলেটার পরনে বেশ দামী পোশাক ছিল। নোংরা কাদা ও রক্ত মাখা ছিল বলে সেগুলো রাতেই পাল্টে ফেলতে বলেছিলেন। ওগুলো যত্ন করে রেখেছেন তিনি। পরে কাজে লাগতেও পারে। তবে ঘটনাস্থলে যা দেখে এসেছেন, মনে হচ্ছে লাগবেই। অমিয় নিজের পোশাক দিয়েছিল ছেলেটাকে। সেটাই পরে আছে। ছেলেটার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালেন তিনি। বেশ দামী আধুনিক স্মার্টওয়াচ।
বললেন, “আরেকবার মাথা ঠাণ্ডা করে বলো কী দেখেছিলে কাল রাতে?”
৪. আজ শহর থেকে ফিরতে একটু রাতই হয়ে গিয়েছিল মৃন্ময়ের। মৃন্ময় সাহা। এই গ্রামে জন্ম হলেও অনেক কম বয়স থেকেই সে গ্রামের বাইরে তার কাকুর কাছে থাকে। সেখানেই পড়াশোনা করেছে। এই বছর চারেক গ্রামে ফিরেছে। এখানে নিজের বলতে কেউ নেই। গ্রামের পুরোনো বাড়িটা কাকু আগে থেকে লোক লাগিয়ে পরিষ্কার করিয়ে রেখেছিল। সেখানেই থাকে। নিজেই রান্না করে।
এক হাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জালিয়ে সাইকেলে আসছিল। টর্চ আনতে ভুলে গিয়েছে। যদিও ট্রেন যে এত লেট করবে কে জানতো! বিকেলে আসার টাইম, এসেছে রাত করে। মিনিট পাঁচেক সাইকেল চালিয়ে বুঝলো আজ রাস্তায় সে একা। মেঘটাও আসতে পারে। সাইকেলের স্পিড বাড়ালো। হঠাৎ, সামনে কয়েকটা আলোর ঝলক দেখতে পেলো সে। একজন লোককে ঘিরে ধরেছে কয়েকজন। লোকটাকে চেনে। পাড়ার পার্টির যুব নেতা। ভালো মানুষ। বোধহয় পার্টির কোনো ঝামেলা। তবে এত ভাবার সময় তার ছিল না। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লোকগুলোর ওপর। এই তার এক বদ অভ্যেস। কাউকে বিপদে দেখলে স্থির থাকতে পারে না। তবে দারুন ফিট শরীর থাকা সত্ত্বেও অসুবিধা হচ্ছিল। চারজন লোকের সঙ্গে একা পারে উঠবে কিভাবে সে! সেই সময়েই একজনের হাতে কিছু একটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো পড়ে থাকা তাদেরই টর্চের আলোয়।
৫. যখন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ থানায় রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে এসে পড়েছিল ছেলেটা, তখনও বিড়বিড় করছিল “ওকে মেরে ফেলবে। তুহিনদাকে বোধহয় মেরেই ফেলবে...”। খুব সংক্ষিপ্তভাবে খবরটা জেনে নিয়ে ছেলেটাকে থানায় কনস্টেবলের জিম্মায় রেখে অকুস্থলে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সঙ্গে আরেক অফিসার মহিন সান্যাল। জিপে উঠে ডাক্তারবাবু তন্ময় ভদ্রকে ফোন করেছিলেন। ছেলেটার শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত আছে। হাসপাতাল এখান থেকে অনেক দূরে। প্রাথমিক চিকিৎসাটা ডাক্তারবাবুই করবেন। তবে অকুস্থলে গিয়ে যা দেখেছিলেন, তাতে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! মহিন হড়হড় করে বমি করে ফেললো পাশে।
৬. কেউ মাথাটাকে প্রবল আক্রোশে থেঁতলে দিয়েছে। খুলি ভেঙে গেছে। হাত মুচড়ে ভেঙেছে কেউ। তবে সবচেয়ে বিভিৎস অংশটা হলো, তুহিন সরকারের পেটটা কেউ নিপুণভাবে কেটেছে। ভেতরে যেখানে যকৃৎ থাকার কথা, সেই অংশটা খালি। দুই উরু থেকে মাংস কেউ কেটে নিয়েছে। রক্তে ভিজে কালচে হয়ে গিয়েছে মাটির রাস্তাটা।
৭. জবুথবু হয়ে বসেছিল মৃন্ময়। শক কাটেনি বোধহয়। এমনিতে বয়সে বড় হলে কী হবে, মনটা তার বেশ নরম। কনস্টেবল অমিয় ঘোষ কিছুটা দোনামনা করেও ছেলেটার কাছে বসলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি মৃন্ময়কে চেনেন। মৃণ্ময়ের বাবা আর তিনি সহপাঠী ছিলেন। বন্ধু মারা যাওয়ার পরে ছেলেটার টুকটাক খবর নিতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সূত্রটুকু প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই সময়ে ছেলেটার পাশে থাকা উচিত। শহরের ভদ্র ছেলে, এইসব ঘটনার শক নিতে পারবে তো? তবে একটু রাগও হচ্ছিল ছেলেটার ওপর। খুবই বোকা না হলে তুহিন সরকারকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রাখে কেউ? মরে বরং ভালোই হয়েছে। গ্রামের মেয়েগুলো এবার একটু শান্তিতে থাকবে। যদিও ছেলেটা নতুন। তাই বোধহয় এখনও তুহিন সরকারকে চিনে উঠতে পারেনি। চিনলে, অমিয়বাবুর বিশ্বাস, ফিরেও তাকাতো না মৃন্ময়।
৮. মৃন্ময় নিজেই রান্না করছিল আজকেও। আজ রবিবার। তুহিন সরকারের বাবা ও পার্টির কিছু সদস্য তার বাড়িতে আসবেন। নিজের ক্ষমতায় যেটুকু পারে, সেটুকু আয়োজন করেছে। আসলে ছেলে মারা গেলেও তার প্রতি একটু কৃতজ্ঞতা আছে তুহিনের বাবার। এই সমাজে কেই বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? নিজের জীবন বিপন্ন করে কেই বা মানুষের পাশে থাকে!
৯. মাংসটা মৃন্ময় ভালোই রান্না করে। তার ধৈর্য প্রচুর। ডিপ ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে কিছুক্ষন পর নরম মাংসে নুন আর হলুদ দিয়ে আবার কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। তারপর আবার একটু টক দই, একটু পেয়াঁজ ভাজা, একটু লেবুর রস দিয়ে আবার রেখে দিতে হবে। তারপর কষানোর পালা। এখানেও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। হাই হিটে রান্না করতে হবে। কিন্তু কোনোভাবে কড়াইতে লেগে গেলেই বিপদ। তাপমাত্রা বাড়িয়ে ও কমিয়ে এমনভাবে কষাতে হবে, যাতে মাংসের জল না বেরিয়ে আসে। তারপর অবশ্য বিশেষ কাজ নেই। মাপ অনুযায়ী একটু গরম জল দিয়ে ঝোল তৈরি করতে হবে। আজকেও মাংসটা জব্বর হয়েছিল। অতিথিরাও প্রশংসা করছিলেন। তুহিনের বাবা তো চেটেপুটে খেলেন। বললেন, “একজন ছেলে গিয়েছে তো কী? আজ থেকে তুমিও আমার ছেলে।”
১০. ছোট বেলা থেকেই ভয়ঙ্কর ক্যালকুলেটিভ সে। ঠাণ্ডা মাথার। পড়াশোনায় খুবই ভালো। কিন্তু সবচেয়ে যেটা বেশি, সেটা প্রতিশোধস্পৃহা। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন ঘৃনা। নিজের গায়ে ছুরিটা বসিয়ে দিতে তাই তার একটুও কষ্ট হয়নি। তার পরের প্ল্যানগুলো সে সাজিয়েই রেখেছিল অনেকদিন থেকেই। ছুরিটা বসিয়ে দিয়ে নিজের গ্লাভসটা খুলে ফেললো। বর্ষাতিটা আগেই খুলেছে। ওখানে লেগে ছিল তুহিন নামক শয়তানের রক্ত। ও জানে থানায় কোনো কুকুর নেই। মাংসটা বর্ষাতিতে মুড়ে মাটিতে যেখানে পুঁতে রেখেছে, সেই খোঁজ কেউ পাবে না। তার আগেই ওই জিনিসের ব্যবস্থা সে করে নেবে। সে তার কাকুর কাছে শুনেছে কিভাবে এই গ্রামেরই এক নাবালিকাকে তুহিন ও তার দলবল ধর্ষণ করে খুন করে, কিভাবে প্রমান লোপাট করে তুহিনের বাবা, সামান্য প্রতিবাদ করতেই কিভাবে মিথ্যে চুরির অপবাদ দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয় তার বাবাকে।
তুহিনের মাংসটা আজ ভালোই সুস্বাদু হয়েছিল। আরও বাকি। আবারও মাংস রান্না করবে মৃন্ময়। মনে মনে প্রত্যেকের জন্য তৈরি করা প্ল্যানগুলো আবারও মাথায় ঝালিয়ে নেয় মৃন্ময়। এক... দুই...তিন... চার...পাঁচ...
Comments
Post a Comment