শ্রীকান্তের সহিত তো সকলেই পরিচিত। আমিও পরিচিত। সে এক কোন শৈশবকালে এক আত্মীয়ের গৃহে পিতার সহিত নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম। সে স্থানেই আমার প্রথম শ্রীকান্তর সহিত পরিচয়। আলাপ হইবার মাত্রই কেমন যেন মোহাবিষ্ট হইয়া পড়িলাম। ইহা জানিতাম যে তাহাকে সঙ্গ করিয়া লইয়া আসিবার অনুমতি কদাচিৎ পাইব না। তাই আর কোনোকিছু আগুপিছু না ভাবিয়া পুস্তকখানি চুরি করিয়া লইয়া আসিয়াছিলাম।
হাঁ, ইহা আমিও জানি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই কোনকালেই বলিয়া গিয়াছেন, "চুরি করা মহা পাপ"। আজ আমি তাহা স্বীকারও করি, কিন্তু আজ আমি অনুতপ্ত কিনা জানিনা। কারণ, যে মোহের বন্ধনে সে আমায় বাঁধিয়াছিল, ঐ শিশুকালে উহার বন্ধন কাটানো আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
দাঁড়ান দাঁড়ান, কেহ যেন ইহা ভাবিয়া লইবেন না যে শ্রীকান্ত আমায় এমন চৌর্যবৃত্তি করিতে বাধ্য করিয়াছিল! আমায় তো আবিষ্ট করিয়াছিল অপরজন।
ঐ যে লম্বা হাত, ধূসর মলিন জামা, অবিন্যস্ত কেশ, ধূলিমাখা পা , কৃষ্ণবর্ণের বালকটি। যে বালকটি নিশিকালে একা ডিঙ্গি লইয়া মাছ ধরিবার তরে বাহির হইয়া যাইত, আবার অন্ধকারে বাঘরূপী বহুরূপীকে কোনো ভয়-ডর ছাড়াই খুঁজিয়া বাহির করিত, যাহার নিকট জীবন কথার অর্থ তথাকথিত সমাজকে তোয়াক্কা না করিয়া চলা -- ঐ বালকটিই।
পুস্তকখানি শেষ করিবার পর শরৎবাবুর উপর রীতিমত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলাম। কারণ, সে সময় পুরো উপন্যাস জুড়িয়া আমি ইন্দ্রকে খুঁজিয়াছিলাম। রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তের মধ্যাহ্নভোজের জন্য কী ব্যঞ্জন রাঁধিল, তাহাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।
ঐ যে সেদিন চক্ষু মুছিতে-মুছিতে কোথায় অদৃশ্য হইলো, তাহার পর সারা পুস্তক জুড়িয়া তাহাকে খুঁজিলাম, কিন্তু কোত্থাও পাইলাম না। কিশোরী মন বারংবার চাহিয়াছিল...ঠিক যেমন করিয়া থিয়েটারে হারাইয়া যাওয়া পুত্র ফিরিয়া আসে, ঠিক তেমন করিয়াই ইন্দ্র যেন পুনর্বার ফিরিয়া আসুক।
কিন্তু না, শরৎবাবু তাহাকে আর ফিরাইয়া আনেন নাই। ঐ বালিকা বয়সে হতাশ হইয়াছিলাম। শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মনে-প্রাণে চাহিতেছিলাম আবার যদি একবার তাহার দেখা পাই। কিন্তু জানেন কালের নিয়মে বয়স যত বাড়িয়াছে, তত ধারণার পরিবর্তন হইয়াছে।
ভবঘুরে ইন্দ্রনাথের চরিত্রকে বাংলা কথা সাহিত্য কোন স্থান দিবে, আমার তাহা জানা নাই, কিন্তু আমি আমার হৃদয় প্রাঙ্গণে তাহার স্মৃতি আজীবন লালন করিব।
এখন মনে হয়, ভাগ্যিস সে ফিরিয়া আসে নাই, সে ফিরিয়া আসিলে তাহার ইন্দ্র হওয়া হইত না। তাহা হইলে সে বোধকরি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই হইয়া যাইত।
সাহিত্য সমালোচক ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ সত্য পরিস্ফুট করিতে মন্তব্য করিয়াছেন, "বর্ণপরিচয়ের রাখাল হইতে আরম্ভ করিয়া অনেক দুষ্ট, লেখা-পড়ায় অমনোযোগী বালকের কাহিনী সাহিত্য বা সাহিত্যের ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু সমগ্র বাংলা সাহিত্য ইতিহাস তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াও ইন্দ্রনাথের জোড়া মিলে না।"
হা ইহা বড় সত্য কথা, আমিও খুঁজিয়া পাই নাই। শুধু আমি কেন, স্বয়ং শ্রীকান্তও খুঁজিয়া পায় নাই। অমন পরদুঃখকাতরতা, নির্ভীকচিত্ততা , সারল্যের স্নিগ্ধতাতে কেবল শ্রীকান্ত কেন, যে কোনো মানুষই প্রেমে পড়িতে বাধ্য।
অন্নদা যখন শ্রীকান্তর দান ত্যাগ করিয়া ইন্দ্রের দান গ্রহণ করিয়াছিল, তখন শ্রীকান্তও বুঝিয়াছিল যে স্থানে ইন্দ্র দান করে, সেই স্থানে সে হাত বাড়ায় , এমন সাধ্য তাহার নাই। ঐ তুলনাহীন কিশোর চরিত্রের দীপ্তিতে আমার নিকট বাকি সকল চরিত্রই নিষ্প্রভ মনে হয়।
সমাজের সচল প্রবাহ হইতে ইন্দ্র যেদিন হারাইয়া গেল, ওইদিন যেরকম বেদনা শ্রীকান্ত অনুভব করিয়াছিল, তেমনই আমার হৃদয়েও দামামা বাজিয়া উঠিয়াছিল। কিশোরী বয়সে দুঃখ পাইয়াছিলাম, কিন্তু এখন সে চরিত্র আমায় হাতছানি দেয়।
আমি যখনই আমার সখীদের নিকট ইন্দ্রের গল্প করিয়াছি, তাহাদের মুখে বারংবার ইহাই শুনিয়াছি, তাহারা এমন প্রেমিক চাহে। এমন উদ্দাম, মাতাল, উদাস পুরুষই তাহারা তাহাদের জীবনে কামনা করে।
কিন্তু জানেন, আমি কোনোদিনই ইন্দ্রের প্রেমে পড়িনাই, আমি কোনোদিনই ইন্দ্রকে প্রেমিক রূপে দেখিতে পাই নাই। কারণ, আমি ইন্দ্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজিয়া ফিরি যে। অমন উদ্দাম মাতাল করা চরিত্রকে নিজের মধ্যে লালন করিতে কে না চায়? অমন করিয়া হারাইয়া যাইতে কয়জন পারে? অমন নির্ভয়ে মাতাল নদীতে খেয়া বাওয়ার সাহস কয়জন রাখে?
আমি চাহি অমন করিয়া হারাইতে, অমন করিয়া বাঁধন খুলিয়া উন্মুক্ত হইতে, অমন শীতের রাত্রেও অম্লান বদনে অবলীলায় নিজ গাত্রের শাল খুলিয়া অপরকে দিতে, অমন করিয়া শৌর্য ও সম্পদের প্রাচুর্য -- সবকিছু অবলীলায় ত্যাগ করিয়া হারাইয়া যাইতে, জ্যোৎস্না রাত্রে বাঁশি লইয়া একলা নদীতীরে বসিয়া থাকিতে,
আমি চাহি অমন করিয়া ইন্দ্র হইতে।
—তিতির
Comments
Post a Comment