ফির ভি তু ভুল জায়ে তো ম্যা ক্যা করুঁ...”
গানটা গুনগুন করতে করতেই ছেলেদের খাতাপত্র দেখছিলাম। হ্যাঁ, তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। ক্লাসের সারপ্রাইজ টেস্ট জাস্ট। বিষয়টা অঙ্ক। তাই খাতা দেখার জন্য তেমন মনোযোগ দেওয়ার দরকারই পড়ে না।
গানটা বেশ লাগে। আমি বাড়ি থেকে দূরে থাকি। সদ্যই অনেকটা দূরের একটা জায়গা থেকে নতুন একটা জায়গায় ট্রান্সফার হয়েছে। নতুন জায়গাটা তেমন একটা ভালো লাগে নি এখনো। জঙ্গলমহল। তবে এখানকার রাতগুলো ভালো। ঝিঁঝিঁর আওয়াজ, ভাড়াবাড়ির টিনের ছাদের ওপর হাল্কা বৃষ্টির শব্দ...আহা।
আর কয়েকটা খাতা বাকি। পরে দেখবো। বৃষ্টিটা বেশ জোরে এসেছে। লোডশেডিংও হয়ে গেল। মোম জ্বালাবো না। চোখদুটোকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার...
গান শুনছিলাম। ওই গানটাই রিপিট মোডে চালিয়ে দিলাম। হঠাৎ ফোনটা এলো। ধ্যূস। এত রাতে কে আবার ফোন করে! বিরক্তিকর।
ফোনটা তুলে নাম্বারটা দেখতেই একটু হৃৎস্পন্দন বাড়লো কি আমার? এতদিন পরে...
ফোনটা রিসিভ করলাম। খুবই পরিচিত গলায়, ‘স্যার, আমি শ্রীতমা...’
****
কম করেও আমার শিক্ষকতার জীবন হলো প্রায় ১০ বছর। ইলেভেনে পড়ার সময় থেকে সেই যে পড়ানোর শুরু, ফিরে তাকাতে হয়নি। কম বয়স থেকেই পড়ানো শুরু করায়, আমার ও আমার ছাত্রীদের বয়সের ডিফারেন্স অনেক সময় খুবই কম হয়েছে। তবে আমি আমার ছাত্রীদের সঙ্গে একটা স্ট্রিক্ট কোড মেইনটেইন করেছি। ‘নো ইমোশনাল এটাচমেন্ট’। হয়তো ঐজন্যেই একটা সুনাম হয়েছিল এই টিউশনি লাইনে। বেতন বেশি হাঁকলেও ভালো পড়ানো আর এই স্বভাবের জোরেই টিউশনির অভাব হয়নি।
কিন্তু শ্রীতমা? নিজের বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো এই কথা?
*
আমি ফার্স্ট ইয়ার। ম্যাথ অনার্স। টিউশনি চলছে সমানেই। আমার স্যারই ঠিক করে দিয়েছিলেন ওই টিউশনিটা। মেয়েটা সবে উচ্চ মাধ্যমিক। অঙ্কের একটা টিউটর লাগবে। স্যার নিচু ক্লাস পড়ান না। এছাড়া যেহেতু তাঁর বন্ধুর মেয়ে, তাই একজন ভরসাযোগ্য টিউটর না হলে চলবে না। আর ইয়ে, আমি ততদিনে টিউশনি লাইনে মোটামুটি নাম করেছি, হেঁ হেঁ...
*
মেয়েটার মা নেই। বাবার আদরে বড় হওয়া মেয়ে। তাই হয়তো একটু জেদী। সেই জেদটাকেই অঙ্কে চ্যানেলাইজ করলো মেয়েটা। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমাকে বিশেষ কষ্ট করতেও হয়নি। তবে আমার দিক থেকেই কেমন যেন একটা ইমোশন তৈরি হচ্ছিল। তবে সেটাকে ওই বয়সে অস্বীকার করেছিলাম। এখন বুঝি, মেয়েটিও হয়তো...জাগ্গে।
*
এক বছর কেটে গেছে। ক্লাস ১২। ওর জন্মদিন। শহুরে টাইপের কেক কাটা, মুখে মাখানো ইত্যাদির বালাই থাকবে না আগেই বলে দিয়েছিল। আমি এইসব উপদ্রব থেকে একটু দূরে থাকি। যাইহোক, সকাল থেকেই আমন্ত্রণ ছিল। একটু দেরি করেই পৌঁছলাম। দেখলাম ওর কয়েকজন বান্ধবীই এসেছে জাস্ট। ওর বাবা অভ্যর্থনা করলেন। ভদ্রলোক বেশ আমুদে। গল্প করছিলাম। তারপর আমায় একটা রুমে বসিয়ে তিনি অন্য কাজ করতে গেলেন বোধহয়। একা বসেছিলাম। ভালো লাগে একা থাকতে। ভদ্রলোক জানতেন। তাই বোধহয় ওই রুমটাতে শুধু আমাকেই বসতে বললেন। পাশের রুমে বোধহয় অন্য লোকজন গল্প করছিল। হঠাৎ মনে পড়লো এতক্ষণ বার্থডে গার্ল শ্রীতমাকেই দেখিনি!
*
দরজাটা খুললো। বোধহয় দুপুরের খাবারের ডাক এসেছে। ‘স্যার, সরি। স্নান করছিলাম।’ ও ঢুকলো রুমে। আমি হেঁসে কিছু একটা বলতে গিয়েই থেমে গেলাম....
ওর চোখদুটো নীলচে! এতদিন খেয়াল করিনি!! ভেজা চুল কয়েকটা চোখের ওপর এসে পড়েছে।গোলাপি শাড়িটা ফর্সা গায়ে বেশ মানিয়েছে। কোমরে রুপোর কি যেন একটা...
হয়তো একটু বেশিক্ষণ তাকিয়েছি। মেয়েটার গালে রক্তাভ ছোপ। লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ও বললো, ‘স্যার, খেতে চলুন...’। অপ্রস্তুত হয়ে একটু, খেতে চললাম। খাওয়ার টেবিলে সবাই একসঙ্গে গল্পগুজব করছিল। আমি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। একটা গিল্ট ফিল হচ্ছিল। গিফ্ট দিয়ে চলে এসেছিলাম। সামান্য একটা পারফিউম..
***
এর পর দুইবছর কেটে গেছে। মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে খুবই ভালো রেজাল্ট করেছে। ভর্তি হয়েছে গণিত বিভাগেই। তবে আমি এখন আর পড়াই না। আমিও চাকুরী পেয়েছি ইতিমধ্যেই। অনার্স কমপ্লিট করতে পারিনি। নিম্নবিত্ত পরিবার আমার। সরকারি চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার সাহস হয়নি। মেয়েটা যদিও ফোন করে। ‘পড়া আটকে গেছে, বুঝে নিতে’। তবে একটু বেশিই হয় কথা। পড়ার চেয়ে অ-পড়ার দিকে এগিয়ে যায় কথাবার্তা...
হঠাৎ করেই সরস্বতী পূজার আগের দিন ফোন করে বললো, ‘স্যার, আমাকে ঘোরাতে নিয়ে যাবেন?’
আমি বুঝেছিলাম কথাটার অর্থ। কিন্তু... কিন্তু... এ অসম্ভব। ওদের বাড়ির স্ট্যাটাস ও আমার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। শহুরে এলিট মেয়ে আমার মতো গাঁইয়ার সঙ্গে? না না...বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো আমার শোভা পায় না। মেয়ে কম বয়সী। জেদী। ও বাস্তব বোঝে না। কিন্তু আমি? ঠিক করলাম স্বার্থপর হবো। ওর ভালোর জন্যই স্বার্থপর হবো। বললাম ‘আমার কাজ আছে। হবে না এবার।...”
দেখলাম, অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলাম আমি। দূরে সরতে হবে আমায়। রাত দুপুরে বালিশে কান্না চেপে ফোন করা কমিয়ে কমিয়ে বন্ধ করলাম। জেদের বশে ট্রান্সফার নিলাম।
জঙ্গলমহলে। একটা টিনের একচালা ভাড়া নিয়ে থাকি। একদম অজ পাড়া গাঁ। সামনেই বিশাল বড় একটা বটগাছের জঙ্গল। সামনেটা নিকানো। আদিবাসীরা পুজো করে। মাঝেমধ্যে রাত্তিরে মন খারাপ লাগলে ওখানে গিয়ে বসি। ওদের ঠাকুরকে চিনি না। কিন্তু কিছু রাত্তিরে ওঁর সঙ্গেই বকবক করি। সকালে হাসি পায়।
***
ফোনটা ধরে বললাম, ‘হ্যাঁ। কি ব্যাপার? এত রাত্রে? সব ভালো তো?’
– হ্যাঁ। আজ ইচ্ছে হলো। জানেন স্যার, অনেক ইচ্ছে হয়। কিন্তু, আপনিই তো দূরে চলে গেলেন...
― দেখো, তোমার ভালোর জন্যেই...
― থাক। ছেলেদের ওই একই অজুহাত। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন? আমার ভালো কোনটা, সেটা আমাকে জানিয়েছিলেন একবারও...
― অতীত টেনে কি আর লাভ আছে বলো? পাঁচ বছর পেরিয়ে এসেছি কম করেও।
― জানি। কিন্তু...
কেটে গেল ফোনটা। কল ঘুরিয়েও পেলাম না। ঘড়ি দেখলাম। প্রায় রাত দেড়টা। আজ আর ঘুম আসবে না। বাইরে দেখলাম বৃষ্টিও কেটে গেছে। বেরোবো? টর্চ নিয়ে ওই বটগাছটার দিকে এগিয়ে গেলাম। কানে হেডফোন। ওই একই গান রিপিট মোডে তখনও...
হাত দিয়ে ভেজা সিমেন্টের চাতালটা মুছে বসলাম। বটগাছের মুখোমুখি। চোখ বন্ধ করে শুনছিলাম গানটা...
“ইস্ক কি ওয়ারদাত কুছ ভি না থি
বড় গই বাত, বাত কুছ ভি না থি...”
বৃষ্টির পরের বিষণ্ণ রাত্রির হওয়া মুখে এসে লাগছিল। কতক্ষন বসেছি জানিনা... চোখ কেন ভিজে আসছিল জানিনা। জানিনা? নাকি জেনেও জানতে চাইছি না...
হঠাৎ, হঠাৎ চেনা এক সুগন্ধ। সামনে এ এ একি! না, অসম্ভব! কিভাবে সম্ভব?
সেই ভেজা চুল...ভেজা শাড়িটা গায়ে লেপ্টে রয়েছে। মাদকতাময়ী হয়েছে ও আরও...কোমরবন্ধে আটকে ছিল আমার চোখটা...
―সারপ্রাইজ, স্যার...
―মা...মা...মানে...
―ঘোরাতে নিয়ে যাবেন না আপনি, জানি। আসবেন আমার সঙ্গে? চলুন না প্লিজ...
নীলচে চোখদুটোর দিকেই তাকিয়েছিলাম আমি। একবার ভুল করেছি ওকে দূরে সরিয়ে দিয়ে। কিন্তু তারপর কি আমি সুখী হয়েছি? ও খুশি হয়েছে?
ও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে... আবার হালকা বৃষ্টি শুরু হলো...হাতটা ধরলাম ওর...
****
“জঙ্গলমহলে রহস্যমৃত্যু”
নিজস্ব সংবাদদাতা, রাউতোড়া।
স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের মৃত্যু নিয়ে গ্রামে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ভাড়াবাড়ির সামনের চাতালে শায়িত অবস্থায় তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয় পুলিশ। গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।”
“দুর্ঘটনায় মৃত্যু যুবতীর”
নিজস্ব সংবাদদাতা, বারাসাত।
সন্ধ্যেয় স্কুটারের সঙ্গে এক মালবাহী ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে স্কুটার আরোহী যুবতীর ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনাগ্রস্ত যুবতী স্থানীয় শিল্পপতি অমল মিত্রের একমাত্র কন্যা শ্রীতমা মিত্র বলে জানা গিয়েছে।
Jaygar nam blbn bekar Ami ghurte jabo...AJ kal oi chakure chhara keu..mne...
ReplyDelete