Book 📚 পটমঞ্জরী

বারবার ভাবতাম, দ্রুতপঠনের অভ্যাসটি কি একেবারেই গেল? নইলে, ইদানিং কোনো বাংলা ফিকশন তেমনভাবে শেষ করতে পারছি না কেন? কষ্ট করে পড়তে হচ্ছে। 

ভুল ভাঙিয়ে দিল, ‘পটমঞ্জরী’। 

প্রথমেই বলে রাখি, আমি ইতিহাসে একেবারেই কাঁচা। ইতিহাসনির্ভর এই বইয়ের ইতিহাস বিশ্লেষণ আমি তাই করতে অপারগ। আমায় বেশি টানে ন্যারেটিভ নির্মাণ। লেখক কি আদৌ উপন্যাস লিখতে পেরেছেন? নাকি ‘ইতিহাসে’ই আটকে গেছেন?

‘পটমঞ্জরী’ উপন্যাসটি ‘ছোট’ নয়। প্লটের বিস্তারও তাই বিশাল অঞ্চল জুড়ে। তিব্বত, চীন, বাংলা, কাশ্মীর...। গল্প এগিয়েছে ভিন্ন সময়কাল জুড়ে। মহাভারতের কাল থেকে মাৎসন্যায়ের কাল পর্যন্ত নানা আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী জুড়ে গিয়েছে এক সূত্রে। বিপ্লব, প্রতিস্পর্ধার ধারক হিসেবে ধর্ম রয়েছে বাঙালিত্বের ওপর ভিত্তি করে। অথবা, বাঙালিত্ব রয়েছে ধর্মকে আশ্রয় করেই। সহজিয়া বৌদ্ধ, শৈব ও নানান লৌকিক ধর্ম এক মহৎ উদ্দেশ্যে নানান মতবিরোধ সরিয়ে রেখে একত্রিত হয়েছে। কী সেই মহতী উদ্যোগ? সেটা জানার জন্য পড়তে হবে বইটি। 

রয়েছে নারীলোলুপ পুরুষের দল। রয়েছে পুরুষের চিত্তবিভ্রম ঘটানো নারীরা। রয়েছেন কাশ্মীর থেকে গৌড় প্রদেশের মহাবিক্রম যোদ্ধারা। 

রয়েছে প্রাচীন ইতিহাসের অভিশাপ হিসেবে উঠে আসা এক প্রবল ক্ষমতাশালী নারী। রাণী। রয়েছে তাঁকে সঙ্গ দেওয়া প্রবলপ্রতাপ একেশ্বর প্রকাশচন্দ্র। 

কিন্তু, রয়েছেন তিনিও। ওই যে রহস্যময়ী যোদ্ধা। শবরবজ্রের পালিতা কন্যা। তিনি খড়্গধারী, বন্য শৃগালবাহিনী তাঁর কথা মেনে চলে। তিনি আশ্রিতের কাছে স্নেহময়ী। তিনি যুদ্ধে ভয়ঙ্করী। শত্রুমাংসে তাঁর অরুচি নেই। তাঁর বাহিনীর যুদ্ধ বিভৎসতাকে ভয় করে সবাই...

সব মিলিয়ে, বইটি হাতে পেয়েছিলাম শনিবার স্কুল থেকে ফিরেই। তারপর গোগ্রাসে গিলেছি। ইতিহাসের তথ্য, পঠনের গতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটাই বোধহয় ঐতিহাসিক উপন্যাসের সাফল্য। ইতিহাস বই নয়, উপন্যাস হয়ে উঠতে পেরেছে ‘পটমঞ্জরী’। বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে কুটিল চক্রান্তের জাল, বীরত্ব, প্রেম এবং রহস্য। বইটি শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত থামা বড় কষ্টের। বাংলা ফিকশন এমন শেষ কবে পড়েছি মনে পড়ে না। 

কিছু লেখা এমন হয় যার দোষগুন বিচার করতে ইচ্ছে হয় না প্রথমবার পড়ার সময়, শুধুই কাহিনীর পরিণতি জানার উদগ্র বাসনা টেনে নিয়ে যায় পাতার পর পাতায়। এই গল্পের অন্তিম পরিণতি প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু তবুও এই বই টেনে রাখে কিসের যেন এক টানে। নস্টালজিয়া? ভালো লেখা পড়ার নস্টালজিয়া? হবে হয়তো।

এবার, একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আমি বই কিনলে শুধুই কাহিনী দিয়ে বিচার করি না। হ্যাঁ, লেখা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে ওই বইয়ের মান অবশ্যই বিচার্য। 

বইটি হার্ডকভার। প্রচ্ছদ ডিজাইন সুন্দর। একটা ভিন্টেজ ছাপ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যা অবশ্যই বইয়ের ভেতরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সঙ্গে রয়েছে এক সুদৃশ্য তালপাতার তৈরি বুকমার্ক। মোটামুটি, প্রোডাক্ট হিসেবেও উৎরে গেছে এটি। 

আরো যা বলার,

১) বইয়ের মধ্যে বানান ভুল চোখে তেমন পড়েনি। তবে ১৪০ পৃষ্ঠার ‘বাদ্যছিন্ন নরমুণ্ড’ কি ‘সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড’ হবে না? নাকি আমারই প্রাচীন বাংলা শব্দজ্ঞানের দৈণতা? তবে, যদি ভুল হয়েই থাকে, ২৭৫ পৃষ্ঠার বইতে একটি বানান ভুল মার্জনা করাই যায়। 

২) কিছু শব্দ বেশ কষ্ট করেই পড়তে হয়। ছাপাখানায় কালি শেষ হয়ে গিয়েছিল কী? বিশেষ করে মাঝের শেষের দিকের কিছু পৃষ্ঠার কয়েকটি শব্দ। মানে, এই খুঁত এত বড় কিছু নয়। কিন্তু খুঁত তো...

৩) এটা কিছুটা অনুরোধ বলতে পারেন। বিগ ব্যাড হিসেবে রাণীর চরিত্র ভালো। কিন্তু আমি হায়ারার্কির টপে দেখতে চেয়েছিলাম তাঁকে। সেটা যখন হলো না, অন্য কোনো উপন্যাসে আরও পাওয়ারফুল কোনো মহিলা চরিত্র কী পেতে পারি না আমরা? বাংলায় এমন চরিত্র শুধুই একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাবে? অল্পে কী সাধ মেটে, বলুন?

যতই হোক, অমন লাস্যময়ী বিগ ব্যাড মহিলাদের ওপর একটু দুর্বলতা থাকাটা কী অন্যায়? আমরা তো আর জিতেন্দ্রিয় নই। 🥺